মানুষমাত্রই স্বপ্ন দেখে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে ভাগ্যবিড়ম্বিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে স্বপ্ন না দেখে বেঁচে থাকা অসম্ভব। দূরদর্শী নেতারা স্বপ্ন দেখেন এবং এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে গোটা জাতিকে উন্নয়নের উচ্চতর শিখরে পৌঁছে দেন। বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান, আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম কিংবা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত কোরিয়া দৃপ্তপদে আশ্চর্য বেগে অগ্রগতির পথে ধাবিত হচ্ছে। অনুরূপ আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেও আমাদের দেশে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই স্বাধীনতা-উত্তরকালে।
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হতদরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য যেন ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্বপ্ন দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের আহ্বান যেন দৃঢ় হয়, আর ১/১১-এর প্রয়োজন যেন বাংলাদেশের মাটিতে না হয়। আমাদের সবার স্বপ্ন বাংলাদেশ যেন সীমাহীন দুর্নীতি ও অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পেয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি হিসেবে বহির্বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে।
কালে কালে পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশ, জাতি, জনগোষ্ঠী নতুন প্রযুক্তির, উদ্ভাবনীর সার্থক প্রয়োগে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে অন্যদের পেছনে ফেলে ওপরে উঠে এসেছে। দেশের অগ্রগতি জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সুপ্তশক্তির সম্ভাবনা বুঝতে পেরেই মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অপমানিত কোরিয়া এখন বৃহত্তম মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের দৃষ্টিতে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। ৪০-৫০ বছর আগেও উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমরা শুধু সমপর্যায়েরই ছিলাম না, কোরীয় ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার্থে আমাদের দেশে পড়তেও আসত। তথ্যপ্রযুক্তির জাদুস্পর্শে কোরিয়া এখন ইন্টারনেট ব্যবহারের সূচকে একটি অগ্রগামী দেশ। তাদের অগ্রগতির বেগে খোদ ইউরোপের ভ্রমণকারীরাও হতবিহ্বল।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড-এমন একটি বাক্য আর কতগুলো ভাষায় আছে জানা নেই, তবে কোনো যুগেই আমাদের সমাজের নেতারা তা সত্যিকারে উপলব্ধি করেছেন কি না সে বিষয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিশ্বের শহর-রাষ্ট্রগুলোকে বাদ দিলে আমাদের জনঘনত্ব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি; প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলার অবকাশ নেই। উদ্বৃত্ত সম্পদ বলতে কেবল মানুষ যা উন্নয়নের অভাবে অগ্রযাত্রার চাকায় মদদ জোগাচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো শিক্ষা, যাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বায়নের যুগে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা তৈরি করে আত্মসম্মান নিয়ে আমরা উন্নয়নের পথে যাত্রা করতে পারি।
সীমিত সম্পদের দেশে দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে এ ধরনের একটি কাজ খুবই দুরূহ। এখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের জন্য সম্পদের অভাব; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ভৌত অবকাঠামো, ল্যাবরেটরি-সর্বোপরি যোগ্য শিক্ষায় শিক্ষিত, অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের সরকারগুলো শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে নানা মুখরোচক, শ্রুতিমধুর বচন শোনালেও বাস্তবের সঙ্গে এর মিল যৎসামান্যই। শিক্ষার সর্বোচ্চ বরাদ্দের ঢাক স্বাধীনতার পর থেকে বাজানো হলেও একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোরিয়ায় শিক্ষায় মাথাপিছু বিনিয়োগ ১৮০ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৫৫ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, পাকিস্তানে ১০ ডলার এবং আমাদের দেশে মাত্র পাঁচ ডলার। তথ্যপ্রযুক্তিকে থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা, মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘আইসিটি’ শব্দ জুড়ে দেওয়া, আইসিটি ইনকিউরেটর তৈরি, সুরম্য অট্টালিকায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের আবাসন, আইসিটি নীতি, অ্যাক্ট, হাইটেক পার্ক ইত্যাদি বাজওয়ার্ডের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিতেও কোনো সূচকেই আমরা বাংলাদেশকে অতিক্রম করতে পারছি না। কারণ সম্ভবত এই যে আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি না, যেকোনো উদ্যোগের সূচনা করলেও পর্যাপ্ত অঙ্গীকারের অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমাদের দেশের বড় বড় গাড়ি ড্রাইভার না চালিয়ে হেলপাররা চালাচ্ছে-এ কথাটি শুধু রাস্তার জন্যই প্রযোজ্য নয়, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে চিত্রটি একই। অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে রেহাই পেতে হলে এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
কালে কালে মানবজাতির ইতিহাসে কালজয়ী প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়েছে, যা পৃথিবীর চিত্র, সভ্যতার মাপকাঠিকে পর্যন্ত বদলে দিয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি যে গতিতে সভ্যতার চিত্রকে, আমাদের জীবনধারাকে বদলে দিয়েছে, তা অন্য কোনো প্রযুক্তিই পারেনি। শূন্য থেকে বিল গেটস কোনো উত্তরাধিকার ব্যতিরেকেই সর্বকনিষ্ঠ বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়েছেন, তা কেবল তথ্যপ্রযুক্তির মতো সর্বজনীন ও বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন প্রযুক্তির বলেই।
তথ্যপ্রযুক্তি যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে, ঠিক তেমনি বদলে দিতে পারে একটি দেশ কিংবা জাতির ভাগ্যও।
আমাদের মতো সীমিত সম্পদ আর আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশে উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো শিক্ষা এবং জাতীয় কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা। এই দুটি বিষয়ই কার্যকরভাবে জোরদার করতে তথ্যপ্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। স্কুলে শিক্ষক নেই, কলেজে অধ্যক্ষ নেই। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে গ্রহণযোগ্য মাত্রার বাজেট, ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোর অভাবেই। হঠাৎ করে বরাদ্দের কার্যকর বৃদ্ধিও আশা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির জানা ও অভিনব ব্যবহার দিয়ে এর অনেক অভাবই অনেকাংশে মেটানো সম্ভব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং শক্তিশালীকরণের নানা প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে যে সংখ্যক কম্পিউটার বিতরণ করা হয়েছে তা কিন্তু কম নয়। তবে এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের যে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না তা না জেনেই বলা যায়। প্রকল্পগুলো মনে হয় ক্রয়সর্বস্ব, সফলতা শুধু ক্রয়ের মধ্যেই। অথচ বিভিন্ন বিষয়ে কম্পিউটার এইডেড লার্নিং প্যাকেজ তৈরি করে শিক্ষক তথা যোগ্য শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকের অভাব মেটানো সম্ভব। প্রতিটি স্কুলে, কলেজে, ল্যাবরেটরিতে কম্পিউটার ও ডিসপ্লে ডিভাইস স্থাপন করে সারা দিন পালাক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর হৃদয়গ্রাহী মাল্টিমিডিয়া এবং বোধগ্রাহী যুক্তি দিয়ে শেখার বিষয়গুলো অধিকতর ব্যয়সাশ্রয়ী ও কার্যকরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নততর এবং একই সমতলে স্থাপন করা সম্ভব। সীমিত সম্পদের দেশে আহৃত সম্পদের এমন বহুমুখী ব্যবহারই হওয়া উচিত আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শুধু তা-ই নয়, সম্পদ যেখানে সীমিত সেখানে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরির মাধ্যমে তারুণ্যের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে ব্যবহার করে শিক্ষার মানকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারছে না। বোর্ডের মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলাফল নিয়েও নানা সন্দেহ। এমতাবস্থায় নানা বিষয়ে নানা পর্যায়ে অলিম্পিয়াড-জাতীয় প্রতিযোগিতা আয়োজন ও জনপ্রিয়করণের মধ্য দিয়ে আমাদের পাবলিক পরীক্ষা/মূল্যায়ন পদ্ধতিকে যেমন কার্যকর হতে সাহায্য করা যায়, তেমনি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখা যায়। স্কুলে-স্কুলে, কলেজে-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে, এলাকায়-এলাকায় প্রতিযোগিতা দাঁড় করাতে পারলে এ থেকে যে সুফল পাওয়া যাবে তা শিক্ষা বাজেটকে দ্বিগুণ করলেও পাওয়া যাবে না। এসব কর্মকাণ্ডে তথ্যপ্রযুক্তি হতে পারে অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার।
১/১১-এর পর আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা নানা দুর্নীতিতে যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন তা ঘোলা পানির উপস্থিতিতেই। ক্রিয়া সম্পাদনের পরিবেশটি স্বচ্ছ হলে এমন মাত্রার দুর্নীতি হতে পারত না। তাই সরকারি সব দপ্তর, বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিতভাবে আপডেট করা হোমপেজের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা উচিত; ঠিক যেমনটি জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতাদের জন্যও থাকা উচিত। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ডের যথাযথ প্রতিফলন থাকা উচিত হোমপেজে, যাতে করে সাধারণ মানুষ তাঁদের কর্মতৎপরতার ইতিহাস জানতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের শিক্ষার মান যেমন উন্নত হতে পারে, ঠিক একইভাবে ই-হেলথের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত এলাকার সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল এবং নীতিনির্ধারণীকে অধিকতর কার্যকর ও তথ্যচালিত করতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের শিল্প ও কৃষিকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলার জন্যও চাই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বমানের জ্ঞান ও দক্ষতাদানের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে আমাদের ভঙ্গুর ভাবমূর্তিকে অধিকতর উজ্জ্বল ও শক্তিশালী করতে পারি। প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে কোরীয়রা তাদের দেশকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। প্রায় চার গুণ বড় এবং অধিকতর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বাংলাদেশকেও আমরা উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারব। আমাদের দেশমাতৃকার মুখচ্ছবি এখনো আলোকিত ও উজ্জ্বল করতে আমরা পারিনি। অনেক দেশ ও জাতিই সফল হয়েছে। অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও আমরা আমাদের দেশ ও জাতির ভাগ্য বদলে দিতে পারি তথ্যপ্রযুক্তির স্পর্শে; বিদ্যুতের বেগে। সেই প্রত্যাশায় আমাদের কাজ করতে হবে এ মুহূর্তেই। আমাদের নেতাদের দিনবদলের এই চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে, হাসি ফোটাতে হবে কিষানের মুখে, শ্রমিকের মুখে, দেশমাতৃকার মুখে।